কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধিঃ
কিশোরগঞ্জের একটি মাদ্রাসায় চলছে সভাপতির মধ্যযুগীয় বর্বরতা। কথায় কথায় হাত তুলছেন শিক্ষক আর কর্মচারীদের গায়ে। তাঁদের ‘শাসন’ করতে রয়েছে সভাপতির একটি ভয়ঙ্কর লাঠি। কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছেন ঐ লাঠিতে সপ্তাহে দুদিন সরিষার তেল মাখাতে। আবার শিক্ষক-কর্মচারীদের ওপর নানা ভুয়া অভিযোগ তুলে লাঠি শাসনে আদায় করছেন মোটা অংকের ঘুষ।
এদিকে স্থানীয় এমপি আফজাল হোসেন তাকে সভাপতি পদ থেকে বাদ দেওয়ার জন্য ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে ‘ডিও লেটার’ দিয়েছেন বলেও একটি সুত্র নিশ্চিত করেছেন।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসায় এসব ঘটনা ঘটছে বলে জানা গেছে। তবে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছে বলেও জানা যায়। মাদ্রাসাটি ১৯৭৭ সালে বিভিন্ন দাতার ৪ দশমিক ৩০ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাও.মো. শফিউদ্দিন জানান, গোলাম সারোয়ার ঝন্টু ২০১৬ সালে প্রথম মাদ্রাসার বিদ্যোৎসাহী সদস্য হন। পরবর্তীতে সহ-সভাপতি হন। সহ-সভাপতি হবার পর থেকেই তিনি দুর্ব্যবহার এবং অন্যায়ভাবে টাকা আদায় শুরু করেন। অধ্যক্ষ এসবের প্রতিবাদ করায় তখনকার কমিটিকে প্রভাবিত করে তাঁকে অধ্যক্ষের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ২৯ মে গোলাম সারোয়ার ঝন্টু সভাপতি হন। এর পর থেকেই শিক্ষক-কর্মচারীদের মারধর, মানসিক নির্যাতন ও তাঁদের কাছ থেকে আবার নানা ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে টাকা দাবি করতে থাকেন।
অধ্যক্ষ জানান, নতুন শিক্ষক নিয়োগ পেলেই তাঁদের কাছ থেকে আপ্যায়নের কথা বলে সভাপতি টাকা আদায় করেন। এরকম একজন শিক্ষকের কাছ থেকে ১২ হাজার টাকা নিয়েছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক খন্দকার কামরুজ্জামান ও সহকারী মৌলভী মাহফুজুর রহমানের কাছ থেকে মাদ্রাসার উন্নয়নের কথা বলে ১০ হাজার টাকা করে নিয়েছেন। কিন্তু মাদ্রাসার কোন কাজে এসব টাকা খচর না করে সভাপতি ব্যক্তিগতভাবে আত্মসাত করেছেন।
মাও.শফিউদ্দিন আইনি লড়াইয়ে আবার অধ্যক্ষের পদ ফিরে পেলেও তাঁর এখনও ৫ বছরের প্রায় ৪০ লাখ টাকার বেতন- ভাতা বকেয়া রয়েছে। সভাপতির আচরণের কারণে মাদ্রাসার মারাত্মক অবনতি ঘটে। শিক্ষার্থী ৮০০ থেকে দু’শ হয়ে গিয়েছিল। পুরনো অধ্যক্ষ ফিরে আসায় শিক্ষার্থী এখন ৬০০। বৃহস্পতিবার মাদ্রাসায় সরেজমিন অনুসন্ধানে গিয়ে এসব বিভীষিকাময় চিত্র ও তথ্য পাওয়া গেছে।
অধ্যক্ষ জানান, মাদ্রাসাটি আগে উপজেলায় ফলাফলে শীর্ষ পর্যায়ে ছিল। তিনি ২০১৭ সালে বাজিতপুর উপজেলায় শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে সম্মাননা ক্রেস্টও পেয়েছিলেন। মাদ্রাসায় শিক্ষক রয়েছেন ২৩ জন, আর কর্মচারী রয়েছেন তিনজন। মাদ্রাসায় গেলে অফিস সহাকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর খায়রুল ইসলাম জানান, তিনি একদিন জরুরি কাজের জন্য ২০ মিনিট বিলম্বে ১০টা ২০ মিনিটে মাদ্রাসায় গিয়েছিলেন। এর জন্য সভাপতি তাঁর হাতে লাঠি দিয়ে আঘাত করে রক্তাক্ত জখম করেন। ৭ দিন চিকিৎসা করাতে হয়েছে। তাঁর মা মারা যান ২০২২ সালের ২৫ জুন। সঙ্গত কারণেই সেদিন তিনি মাদ্রাসায় যাননি। কিন্তু সভাপতি সেদিনও ছুটি মঞ্জুর করেননি। তাঁর নামের পাশে অনুপস্থিত লিখে রাখেন। এমনই অমানবিক আচরণ করছেন সভাপতি গোলাম সারোয়ার ঝন্টু।
অধ্যক্ষ মাও.মো. শফিউদ্দিন জানান, তাঁকেও একদিন বাঁশ নিয়ে মারতে গিয়েছিলেন। অন্যরা নিবৃত্ত করেছেন। আরেক দিন অধ্যক্ষ মোটর সাইকেলে মাদ্রাসায় ঢোকার সময় পেছন দিক দিয়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিয়েছেন। তিনি প্রায়শই শিক্ষকদের লাঠির ভয় দেখিয়ে বশে রাখার চেষ্টা করেন।
মাদ্রাসার সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শফিকুর রহমান জানান, তাঁর ওপর সভাপতি ঝন্টু অনিয়মের ভুয়া অভিযোগ তুলে ২৫ লাখ টাকা ফেরত চান। কিন্তু তিনি এখনও কোন টাকা দেননি। দাতা সদস্য এম ইউসুফ খান জানান, ভুয়া অনিয়মের অভিযোগে তাঁর কাছেও সভাপতি ৭ লাখ ৭০ হাজার টাকা দাবি করে নোটিশ পাঠিয়েছিলেন। তিনিও টাকা দেননি। সভাপতি কমিটির অভিভাবক সদস্য জহিরুল ইসলাম কাজলকে ভুয়া অভিযোগে কমিটি থেকে বাদ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত করে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে।
সভাপতির এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে শিক্ষকগণ নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে প্রতিকার চেয়ে বিভিন্ন সময় লিখিত আবেদন করেছেন। এমপি আফজাল হোসেন নিজেও সভাপতিকে বাদ দেওয়ার জন্য ডিও লেটার দিয়েছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. মোহাম্মদ কামরুল ইসলামের গত ৪ জানুয়ারির স্বাক্ষরে জেলা প্রশাসকের কাছে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। তাতে এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে সভাপতি গোলাম সারোয়ার ঝন্টুকে প্রশ্ন করলে অফিস সহকারীকে মারধরের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘অফিস সহকারীর বিলম্বে মাদ্রাসায় আসার বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তিনিই আমাকে মারতে এসেছিলেন। এসময় তাকে ধাক্কা দিলে পড়ে গিয়ে সামান্য আঘাত পেয়েছিলেন। আমি তাকে চিকিৎসাও করিয়েছি।’ লাঠির বিষয়ে প্রশ্ন করলে বলেন, ‘এটি প্রহরির জন্য কেনা হয়েছিল, আমার জন্য নয়। এখন সবাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন। তিনি শিক্ষকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেছেন। তবে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে খাতাপত্র পরীক্ষা করে টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া যায়। পরে কমিটির রেজুলেশন করেই টাকা ফেরত দিতে নোটিশ করা হয়েছিল বলে তিনি জানিয়েছেন। অফিস সহকারীকে মায়ের মৃত্যুর দিন অনুপস্থিত লেখার বিষয়ে বলেন, ‘এদিন আমি ঢাকায় ছিলাম। অন্য কেউ অনুপস্থিত লিখে আমার দোষ দিচ্ছেন।
এদিকে এমপি আফজাল হোসেনের সঙ্গে কথা বললে জানান, ‘সভাপতি আমার আত্মীয়। তাকে আমিই সভাপতি বানিয়েছিলাম। তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে কিছু বলতে পারবো না। সেটি কর্তৃপক্ষ তদন্ত করলে জানা যাবে। তবে সভাপতি একজনকে মারধর করার কারণে আমি তাকে বাদ দেওয়ার জন্য ডিও লেটার দিয়েছি।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদকে প্রশ্ন করলে ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তদন্তের নোটিশ পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বিষয়টি তদন্তের জন্য বাজিতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দিয়েছেন।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ২০২১. © হাওর টাইমস ২৪, এই ওয়েবসাইটের কোনো, লেখা, ইমেইজ, ভিডিও চিত্র, অডিও, অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ যোগ্য।