বীরত্ব গাঁথা ডেক্সঃ
অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রমের আজ ৫২ তম শাহাদৎ বার্ষিকী।
১৯৭১ সনের ৮ আগষ্ট তিনি সুনামগঞ্জ জেলার গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর সাচনা পাক হানাদারদের হাত থেকে দখল মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম এ যুদ্ধে তিনি কমান্ডার হিসাবে নেতৃত্ব দেন। ভয়াবহ এই যুদ্ধে মুক্তিসেনাদের প্রবল আক্রমণে ৩৬ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং এর ফলে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে সাচনা বন্দর শত্রুমুক্ত হয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে পলায়নরত পাকসেনাদের কাভারিং ফায়ারের একটি বুলেট শহীদ সিরাজের কপালে বিদ্ধ হলে তিনি গুরুতর আহত হন। সঙ্গে সঙ্গে মিত্র বাহিনীর হেলিকপ্টার যোগে ভারত নেওয়ার সময় পথিমধ্যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর লাশ নিয়ে হেলিকপ্টার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নিকট টেকেরঘাটে অবতরণ করে। সেখানে খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।
মৃত্যুর মাত্র ৭ দিন পূর্বে তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁর পিতাকে একটি পত্র লেখেন। সেই চিঠির প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠেছে শহীদ সিরাজের দেশপ্রেমের অপূর্ব নির্দশন। চিঠির ভাষা নিম্নরূপ :
প্রিয় আব্বাজান, টেকেরঘাট
তাং- ৩০-০৭-৭১ ইং
আমার সালাম নিবেন, আশা করি খোদার কৃপায় ভালই আছেন। বাড়ীর সকলকেই আমার শ্রেণীমত সালাম ও স্নেহ রহিল। আলী রাজ, রওশন, মাতাব, রনু, ইব্রাহীম, ফুল মিয়া, সকলেই একত্রে আছি। দেশের জন্য আমরা সকলেই জান কোরবান করিয়াছি। আমার জন্য ও দেশ স্বাধীন স্বহওয়ার জন্য দোয়া করবেন। আমি জীবনকে তুচ্ছ মনে করি। কারণ দেশ স্বাধীন না হইলে জীবনের কোন মূল্য থাকিবে না। তাই যুদ্ধই জীবনের পাথেয় হিসাবে নিলাম। আমার অনুপস্থিতিতে মাকে কষ্ট দিলে আমি আপনাদেরকে ক্ষমা করিব না। পাগলের সব জ্বালা সহ্য করিতে হইবে। চাচা, মামাদের ও বড় ভাইয়ের নিকট আমার সালাম। বড় ভাইকে চাকুরীতে যোগদান করিতে নিষেধ করিবেন। জীবনের চেয়ে চাকুরী বড় নয়। দাদুকে দোয়া করিতে বলিলেন। মৃত্যুর মুখে আছি। যে কোন সময় মৃত্যু হইতে পারে এবং মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত। দোয়া করবেন মৃত্যু হইলেও যেন দেশ স্বাধীন হয়। তখন দেখিবেন লাখ লাখ ছেলে বাংলার বুকে পুত্র হারাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ডাকের অপেক্ষায় থাকুন। আর আমার জন্য চিন্তার কোন কারণ নেই। আপনার দুই মেয়েকে পুরুষের মত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবেন। তবেই আপনার সাধ মিটে যাবে।
দেশবাসী স্বাধীন বাংলা কায়েমের জন্য দোয়া কর। মীরজাফরী করিও না। কারণ মুক্তি ফৌজ তোমাদের ক্ষমা করিবে না এবং বাংলায় তোমাদের জায়গা দিব না। সালাম, দেশবাসী সালাম।
ইতি,
মোঃ সিরাজুল ইসলাম
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার তাকে মরণোত্তর বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে এবং সাচনা নদী বন্দরের নাম করণ করা হয় সিরাজনগর এবং কয়েক বছর আগে সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাষক নীলাদ্রি লেকের প্রকৃত নাম করন করেন শহীদ সিরাজ লেক। যা সবার কাছে শহীদ সিরাজ লেক নামে পরিচিত।
উল্লেখ্য শহীদ সিরাজুল ইসলাম ১৯৭১ সনে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের বিএ শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন। যুদ্ধের শুরুতেই তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন এবং ভারতের আসামে ইকোয়ান ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে তিনি ৫ নং সেক্টরের অধীনে সাবসেক্টর কমান্ডার হিসেবে সাচনা যুদ্ধ ছাড়াও আরও অনেক যুদ্ধে বীরত্বের সাথে অংশগ্রহন করেন। মরহুম মকতুল হোসেন ও গফুরুন্নেছার পুত্র শহীদ সিরাজের ছিলেন দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়।
কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার এলংজুরী ইউনিয়নের ছিলনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করে ছিলেন এই অকুতোভয় দুঃসাহসী বীর।
৫২ তম শাহাদাৎ বার্ষিকীতে বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি হে প্রিয় বীর….
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ২০২১. © হাওর টাইমস ২৪, এই ওয়েবসাইটের কোনো, লেখা, ইমেইজ, ভিডিও চিত্র, অডিও, অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ যোগ্য।