মুহাম্মদ শাহ্ আলম
লেখকঃ আইনজীবী ও কলামিস্ট
ছাত্র জনতার বীরত্ব গাঁথা রক্তাক্ত জুলাই- আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে দেশব্যাপী রাজনৈতিক অঙ্গনে শোরগোল শুরু হয়েছে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বা ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বশীল’ নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে।
কয়েকটি রাজনৈতিক দল তাদের বক্তব্য- বিবৃতি এবং সভা সমাবেশের মাধ্যমে ক্রমাগত ভাবে এই দাবি জানিয়ে আসছে। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট ভাবে নির্বাচনের দিন তারিখ বা রোড ম্যাপ ঘোষণা করেননি।
বিগত ৮ আগষ্ট দেশের একমাত্র নোবেল লরিয়েট ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার কয়েকমাস পর থেকেই কয়েকটি রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্টানের দাবি সামনে নিয়ে আসে।
এরই ধারাবাহিকতায় দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপি এই বছর ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্টানের জন্য সরকারের উপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করে আসছিল। এক পর্যায়ে বিএনপির এই দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন এলডিপি, গণফোরাম,নাগরিক ঐক্য, আন্দালিব রহমান পার্থের জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ১২ দলীয় জোটসহ অন্তত ৩০ টি রাজনৈতিক দল।
এই অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে যে কোন সময় নির্বাচন। কিন্তু বিএনপি ডিসেম্বরে মধ্যেই নির্বাচনের দাবি জোড়ালো করতে থাকে। এতে সরকার এতটাই অসন্তোষ প্রকাশ করেন যে, প্রধান উপদেষ্টা জাপান সফরকালে নির্বাচন প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন ‘সব দল নয়, শুধু একটি রাজনৈতিক দলই চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন চায়। এক পর্যায়ে সরকার এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্টানের সময়সীমা কথা উল্লেখ করেন।
পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাজ্য সফরকালে গত ১৩ই জুন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে প্রধান উপদেষ্টার আনুষ্ঠানিক বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে যৌথ ঘোষণা দিয়েছেন। বৈঠকে সংস্কার ও গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাপেক্ষে ২০২৬ সালে পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও (ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে) নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বাস্তবে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে সংস্কার ও গণঅভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের বিচারের কতটা অগ্রগতি হবে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কারণ বিচার একটি প্রক্রিয়াগত বিষয়। অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম করে বিচার নিষ্পত্তি করতে হয়।
যদিও এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংষ্কার, ফ্যাসিবাদী সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়ার বিষয়টি তরান্বিত হবে বলে অনেকেই আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন। ইতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন বৈঠকের ফলাফল। এতে নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুটা স্বস্তির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু লন্ডন বৈঠকের মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে কয়েকটি রাজনৈতিক দল সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন-তত্ত্ব সংক্ষেপে পি.আর. পদ্ধতির নির্বাচনের ইস্যুটি জোড়ালো ভাবে সামনে নিয়ে আসে। ২৮ জুন ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন’র ব্যানারে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই সমাবেশে জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, নেজামে ইসলাম পার্টি, হিন্দু মহাজোট, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ,বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, খেলাফত আন্দোলনসহ ছোট-বড় অন্ততঃ ১০ সংগঠনের নেতারা অংশগ্রহণ করেন এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের জোড়ালো দাবি তুলেছেন।
বিএনপি এবং এর সমমনা দলের নেতাদেরকে এই সমাবেশে দেখা যায়নি।
সমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। ফলে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্টানের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে সংশয়, সন্দেহ, অনিশ্চয়তার আবহ তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে জামাতে ইসলামি, ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি ইসলামপন্থি সংঘটন ও বামপন্থি দলের সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, সংষ্কার ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ইত্যাদি নানাবিধ ইস্যুর কারণে একইসঙ্গে সমন্বিত পরিকল্পনার অভাব এবং সাংবিধানিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় দেশের মানুষের মাঝে ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত বলে মনে হচ্ছে। সংষ্কার ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা কয়েকটি ইস্যুতে মতপার্থক্য রয়েছে। বিশেষ করে পি.আর পদ্ধতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান সংশোধন করা।
জামাত ও এনসিপি নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে এসেছে। পিআর পদ্ধতি প্রসঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন এই পদ্ধতিতে কেউ নির্বাচিত হলে জনগণের প্রতি তার দ্বায়বদ্ধতা থাকবে না। আর পিআর পদ্ধতির নির্বাচন হলে তা হবে জনগণের সাথে বিচ্ছিন্ন একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য বা পরস্পরবিরোধী অবস্থান রাজনীতিতে অস্থিরতা এবং নির্বাচন নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করছে। ইতোমধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘বিচার, সংস্কার ও নতুন সংবিধান রচনা বাদ দিয়ে নির্বাচন হলে আমরা সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব না। আর সেই নির্বাচন জনগণের নির্বাচনও হবে না। একই সঙ্গে জামাতে ইসলামি ও ইসলামী আন্দোলন বা চরমোনাই পীরের দল সহ আরও কিছু দল যদি দাবি করে পিআর পদ্ধতি ছাড়া কিংবা অন্য কোনো ইস্যুতে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবো না বলে ঘোষণা প্রদান করেন তবে এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে আর ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ ২০১৪,২০১৮ ও ২০২৪ সালে সরকারের কথামতো একতরফা বিনা ভোট, রাতের ভোট ও ডামি নির্বাচনের আয়োজন করে তৎকালীন চীফ ইলেকশন কমিশনারদের বর্তমানে যে পরিণতি ভোগ করতে হচ্ছে, চোখের সামনে এই ঘটনা দেখার পর নিশ্চয়ই বর্তমান নির্বাচন কমিশন ঝুঁকি নিয়ে নিজেকে অনিশ্চিত বিপদে ফেলতে যাবে না। ফলে কয়েকটি রাজনৈতিক দল যে কোনো বাহানা বা অজুহাতে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিলে নির্বাচন যে হবে তা সহজেই অনুমেয়।
কাজেই অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে আলামত ভালো না। আর পিআর পদ্ধতি পৃথিবীর অনেক দেশেই বিদ্যমান আছে। আমাদের দেশে এই কনসেপ্ট একেবারেই নতুন। ফলে পিআর পদ্ধতি আসলে কি জিনিস, এর সুফল ও কুফল কি এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে জনগণ কিভাবে লাভবান হবে তা আমজনতা বিশদভাবে অবগত নহেন। শুধু মাত্র যে সমস্ত রাজনৈতিক দল পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন দাবি করছেন সেই সমস্ত রাজনৈতিক দল তাদের লাভলোকসানের হিসাব রাখছেন সেই সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো এবং রাজনৈতিক সচেতন মানুষ গুলো পিআর পদ্ধতি সর্ম্পকে অবহিত। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচনী এমন এক পদ্ধতি যেখানে পার্লামেন্টের মেম্বার নির্বাচিত হবে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে। কোনো দল মোট প্রদত্ত ভোটের ১০ শতাংশ ভোট পেলে সেই দল আনুপাতিক হারে সংসদের ১০ শতাংশ বা ৩০টি আসন পাবে এবং ৩০০ আসনে মিলে যদি এক শতাংশ ভোটও পায় তবে ৩টি আসন পাবে।
এই ক্ষেত্রে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনী সুফল থেকে বঞ্চিত হবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনেই অসংখ্য স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছে। অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী হয়ে সংসদ সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি ৩০০ আসনে এক পারসেন্ট ভোটও পায় তবে তিনজন সংসদ সদস্য নির্ধারণের কোন ব্যবস্থা এই পিআর পদ্ধতিতে নেই।
তাছাড়া পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে ভোট হবে দলীয় প্রতীকে। প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে দল সংসদ সদস্যের তালিকা প্রনয়ণ করবেন। এতে সংসদীয় আসনভিত্তিক ভোটারগণ ভোট প্রদানের দিন পর্যন্ত জানতেই পারবেন না তাদের এই আসনের এমপি বা সংসদ সদস্যের দায়িত্ব পালন কে করবেন। ফলে ওই সংসদ সদস্যের সাথে ভোটারদের সরাসরি কোনো সম্পর্ক বিদ্যমান থাকার সম্ভাবনা নিতান্তই নগন্য। তাছাড়া যিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবেন তাঁরও ভোটারদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের কোন আগ্রহ থাকবে না,কারণ এমপির তালিকা প্রস্তুত করবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির উর্ধতন নেতৃবৃন্দ। ফলে কেন্দ্রীয় নেতাদের মনোরঞ্জন করতে গাছের গোড়ায় পানি ঢালাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
পিআর পদ্ধতির দাবিদারদের যুক্তি হচ্ছে এর মাধ্যমে ৩০০ আসনে প্রদত্ত সকল ভোটের প্রতিনিধি নিশ্চিত করা, কালো টাকা ও পেশিশক্তি রোধ করা। যদিও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট নিয়ে কোন বক্তব্য নাই। আর কোন সংসদীয় আসনে যদি কোন রাজনৈতিক দলের পেশিশক্তি প্রয়োগের সামর্থ্য থাকে তবে পিআর পদ্ধতির কারণে চেষ্টা করবে যাতে অন্য কোন রাজনৈতিক দলের প্রতীকে যেন একটি ভোটও না পড়ে। অর্থাৎ পেশীশক্তির ভয়ে পিআর পদ্ধতি ভোট করতে হবে এটা কোন যুক্তির হতে পারে না। শুধু নির্বাচন কেন রাষ্ট্রের প্রতিটি ক্ষেত্রে পেশীশক্তি মারাত্মক হুমকি।
কাজেই পেশীশক্তিকে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আর পেশিশক্তি নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। আর কালো টাকা বন্ধ করা ! যেই দেশে মনোনয়ন বানিজ্যে ও পদ পদবি বিক্রির অভিযোগ উঠে সেই দেশে বিনা পরিশ্রমে এমপি হওয়ার জন্য জায়গামতো কোটি কোটি টাকা খরচ করবে না এর গ্যারান্টি কি। কাজেই আমরা মনে করি জনগণের মতামতকে উপেক্ষা করে নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক বিভাজন দেশে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথকে আরো জটিল ও কন্টকময় করে তুলবে। যা কাম্য হতে পারে না। এমনিতেই দেশের মানুষ বিগত ১৬ বছর যাবত ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের অনৈক্য ও নতুন নতুন ইস্যুর কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে যদি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্টানে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এবং একটি অনির্বাচিত সরকার যদি দীর্ঘ দিন রাষ্ট্র ক্ষমতায় অবস্থান করে তবে ৫ আগষ্টের ছাত্র জনতার গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা এবং আত্মত্যাগের আকাঙ্খাকে ম্লান করে দিতে পারে। যা হবে জাতির জন্য দূর্ভাগ্য।
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ২০২১. © হাওর টাইমস ২৪, এই ওয়েবসাইটের কোনো, লেখা, ইমেইজ, ভিডিও চিত্র, অডিও, অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ যোগ্য।