মুহাম্মদ শাহ্ আলমঃ
সারাদেশের বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ যখন ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও পলায়নের বর্ষপূর্তি উদযাপন করছে তখনই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে ষড়যন্ত্রের ডালপালা মেলতে শুরু করেছে। আর এই গভীর ষড়যন্ত্রের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে ঢাকার মিটফোর্ডের ভাঙারি ব্যবসায়ী সোহাগ হত্যাকাণ্ডের নির্মমতা ও বিভৎসতাকে।
ফলে প্রশ্ন উঠেছে আলোচিত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড কি দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির মাষ্টার প্ল্যানের অংশ হিসেবে সংগঠিত করা হয়েছে। রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় গত ৯ জুলাই সন্ধ্যায় চাঁদ মিয়া ওরফে সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ীকে দীর্ঘ সময় ধরে পিটিয়ে ও পাথর দিয়ে থ্যাঁতলে হত্যা এবং নিথর দেহ সড়কে ফেলে নৃশংস কায়দায় ঘাতকদের উল্লাস, একইসঙ্গে অত্যন্ত নিখুঁত ভাবে ভিডিও চিত্র ধারণ করে দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
মজার বিষয় হচ্ছে মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী মাহমুদুল হাসান মহিনের নেতৃত্বে ভাঙাড়ি ব্যবসায়ী সোহাগকে পিটিয়ে পাথর দিয়ে থেঁতলে নির্মমভাবে হত্যার পর লাশ রাস্তায় রেখে নিজেদের লোকজনকে নিয়ে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে মিছিল করছিল মহিন এবং চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে স্লোগানও দিচ্ছিল। অথচ মহিনের বিরুদ্ধে মিটফোর্ড এলাকায় অস্ত্রবাজি, হামলা, মারামারিসহ চাঁদাবাজির ভয়ঙ্কর সিন্ডিকেট গড়ে তুলার অভিযোগ রয়েছে।
বিভৎস এই হত্যাকাণ্ড দেশের মানুষের মন-মস্তিষ্কে চরম ঘৃণা ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক কায়দায় সংঘটিত পৈচাশীক এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় ক্ষুব্ধ সারা দেশের মানুষ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের দৃষ্টামূলক শাস্তি দাবি করেছে। মানুষের এই সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগাতে “উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে” চাপিয়ে দেওয়ার হীন উদ্দেশ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে সরাসরি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে মিছিল বের করে অশালীন কুরুচিপূর্ণ শ্লোগান দিতে দেখা গেছে।
স্বার্থান্বেষী মহল এখানেই থেমে থাকেনি অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকেও অসম্মান করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। কতিপয় কমবয়সী কিশোর জিয়াউর রহমানের ছবি মাটিতে ফেলে এই ছবি অবমাননা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছে। দুই একটি দল যারা অতীতে ফ্যাসিবাদী শাসকদের সাথে সম্পর্ক রেখে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে ফায়দা লুঠেছে সেই দলগুলো এই হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে রাজনীতিতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের তৎপরতা চালাচ্ছে।
ওলট-পালট করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে গণ-অভ্যুত্থানের অর্জন। কূটকৌশলে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ঘায়েল করতে চাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে ‘চাঁদাবাজের দল’ ব্র্যান্ডিংয়ের মিশন শুরু করেছে। বসে নেই বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তিও। ভারতের কতিপয় মিডিয়া তাদের চিরাচরিত অভ্যাসের প্রতিফলন ঘটিয়ে সংখ্যালঘু কার্ড খেলার চেষ্টা করছে।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল এনডিটিভি মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডে শিরোনাম করেছে-‘বাংলাদেশে গণপিটুনিতে হিন্দু ব্যবসায়ী নিহত, লাশের গায়ে নৃত্য করছে হামলাকারীরা। ইন্ডিয়া টুডে-শিরোনাম করেছে ‘বাংলাদেশে হিন্দু ব্যবসায়ীকে কংক্রিটের স্ল্যাব দিয়ে পিটিয়ে হত্যা, লাশের গায়ে উদাম নৃত্য হামলাকারীদের’। এর আগেও ভারতীয় গণমাধ্যমে একাধিক ঘটনায় মুসলিমদের ঘটনাকে হিন্দুদের নির্যাতন করা হচ্ছে বলে পরিকল্পিতভাবে প্রচারণা চালিয়েছে। সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের কল্পকাহিনি প্রচার করেছে। দেশে একটি সরকার বর্তমান। দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা সরকারের অন্যতম এজেন্ডা। সরকার যদি অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করে সেই ক্ষেত্রে যদি কোন রাজনৈতিক দল অপরাধীদের রক্ষায় এগিয়ে আসে তবে অবশ্যই সেই দলকে অপরাধের দায়দায়িত্ব বহন করতে হবে।
মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের সাথে সাথেই যুবদলের কয়েকজনকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবী করেছেন। বিএনপি যেহেতু সরকারে নেই সেই হিসেবে বিএনপির আর কিইবা করার আছে।
বিএনপির নেতৃত্ব ইচ্ছা করলেই সকল অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার সুযোগ নেই। দেশের মানুষের জীবন ও সম্পদ রক্ষাকল্পে বর্তমান সরকারকে সম্পূর্ণরূপে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অপরাধীদের খূঁজে বের করে আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অথচ এই ঘটনায় অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য সরকারকে চাপ না দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও জিয়াউর রহমান সর্বোপরি বিএনপিকে টার্গেটে পরিণত করা হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা তারেক রহমান বিএনপির মতো একটি বৃহৎ ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের কান্ডারী এবং বাংলাদেশের রাজনীতির চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছেন। দীর্ঘ দেড় যুগ যাবত সূদুর লন্ডনে অবস্থান করেও ফ্যাসীবাদী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়ে বিচক্ষণতার সাথে দল পরিচালনা করে কোটি কোটি মানুষের আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। প্রতিনিয়ত তিনি কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিএনপি নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে ভার্চুয়ালি মতবিনিময় করেছেন। উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধা। নির্ধারণ করেছেন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি।
তারেক রহমানের এই রাজনৈতিক উত্থান এবং জনপ্রিয়তাকে ম্লাইন করার জন্য সম্পূর্ণ পরিকল্পিত ভাবে মহল বিশেষ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র অব্যাহত রেখেছে। তারেক রহমানের নেতৃত্বকে কালিমালিপ্ত করতে পারলে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি দুর্বল হয়ে যাবে। আর এই হীন উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীলনকশা অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে বিএনপিকে ‘চাঁদাবাজের দল’ ব্র্যান্ডিংয়ের মিশন নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় শোরগোল শুরু করেছে।
দেশের কোথাও কোনো অঘটন ঘটলে কোনো প্রকার বাছবিচার ছাড়াই প্রকৃত ঘটনা উদঘাটনের আগেই বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদলের নাম জুড়ে দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা চালানো হচ্ছে। অথচ অনেকটা একই সময়ে খুলনায় বিএনপির একজন নেতাকে পায়ের রগ কেটে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে এবং চাঁদপুরে একটি মসজিদের ইমামকেও মসজিদের ভেতর ছুরিকাঘাত করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ও পরিকল্পিত অপপ্রচারকারী মহলটি এই সকল হহত্যাকান্ড নিয়ে একেবারেই নিশ্চুপ। এর আগে গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি হত্যাকান্ড ও মব জাস্টিসের ঘটনা ঘটেছে অথচ সেগুলো নিয়ে তেমন কোন উচ্চবাচ্য করেননি কেউ।
সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ এই হত্যাকাণ্ডকে পূর্বপরিকল্পিত ছিল বলে দাবি করে বলছেন এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ও রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি রয়েছে।
তা না হলে প্রকাশ্য নির্মমভাবে একজনকে হত্যা করে লাশ পাশে রেখেই খুনিরা পালিয়ে না গিয়ে কীভাবে মিছিল-স্লোগান দেয়ার সাহস দেখায়। কেনই-বা ৯ জুলাই ঘটনা কেন হঠাৎ করে ১১ জুলাই ব্যাপক প্রচারণা পেলো ? আগে প্রচার হয়নি কেন? এখানে কি উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে?’ একইভাবে অন্যরাও প্রশ্ন তুলেছেন, মামলার তালিকা থেকে কেন তিনজনের নাম বাদ দেয়া হয়েছে। এর রহস্য কী?
বাস্তবতা হচ্ছে মিটফোর্ডে প্রাগৈতিহাসিক কায়দায় বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের নির্মমতাকে পুঁজি করে গণ-অভ্যুত্থানের অর্জনকে কুলশীল করতে পরিকল্পিত ভাবে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির প্রয়াস চালানো হচ্ছে । গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল একে অপরের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে শ্লোগান দিচ্ছে। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, নেতাদের চরিত্রহণনের মতো নোঙরা খেলায় মেতে উঠেছে। শুরু করেছে মিথ্যাচার।
ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে ক্রমেই অস্থিতিশীল করে তুলছে। যা কাম্য হতে পারে না। আমরা মনে করি দেশ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে।দীর্ঘ ১৭ বছর যাবত দেশের মানুষ ভোটাধিকার বঞ্চিত।অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এক বছরের মধ্যেও নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়নি। সংষ্কার, ফ্যাসিবাদ তার দোসরদের গুম খুন লুটপাট, রাজনৈতিক নিপিড়ন ও জুলাই ম্যাসাকারে যে মানবতা বিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে তার বিচার এবং জনগণের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচনের ব্যবস্থা, দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে নেতিবাচক প্রভাব, সবকিছু মিলিয়ে দেশের মানুষ যখন অস্থিরতার মাঝে দিনাতিপাত করছে সেই সময় জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু গুলো পাশকাটিয়ে কতিপয় রাজনৈতিক দল বিএনপির মত জনপ্রিয় দল ও দলটির কান্ডারী তারেক রহমানকে টার্গেটে পরিণত করেছে। এই ধরনের অপতৎপরতা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি, রাষ্ট্রগঠন ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
লেখকঃ আইনজীবী ও কলামিস্ট
সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত ২০২১. © হাওর টাইমস ২৪, এই ওয়েবসাইটের কোনো, লেখা, ইমেইজ, ভিডিও চিত্র, অডিও, অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ যোগ্য।